পদ্মা সেতু
পদ্মা বহুমুথী সেতু হচ্ছে এমন একটি সেতু যা পদ্মা নদীর উপর নির্মিত হয়েছে । পদ্মা সেতু বিাংলাদেশের সবচেয়ে ব্যায় বহুল একটি সেতু । এর মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের লৌহজংয়ের সাথে শরীয়তপুর ও মাদারীপুর জেলা যুক্ত হয়েছে।এটি ছিলবাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং নির্মাণ প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত।দুই স্তর বিশিষ্ট ইস্পাত ও কংক্রিট নির্মিত ট্রাসের এই সেতুর উপরের স্তরে চার লেনের সড়ক পথ এবং নিচের স্তরে একটি একক রেলপথ রয়েছে।এটি বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু, স্প্যান সংখ্যা ও মোট দৈর্ঘ্য উভয়ের দিক থেকে গঙ্গা নদীর উপর নির্মিত দীর্ঘতম সেতু এবং ১২০ মিটার (৩৯০ ফুট) গভীরতাযুক্ত বিশ্বের গভীরতম পাইলের সেতু।
আশা করা হচ্ছে সেতুটি চালু হওয়ার পর বাংলাদেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
ইতিহাস :
১৯৯৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সরকার রাজধানী ঢাকা ও দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা-খুলনা মহাসড়কে পদ্মা নদীর উপর একটি সেতু নির্মাণের জন্য ৩,৬৪৩.৫০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের প্রস্তাব করে। ৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ১৮.১০ মিটার চওড়া উক্ত সেতুটিকে দেশের সম্ভাব্য দীর্ঘতম সেতু হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল। প্রস্তাবে ১৯৯৯ সালের জুলাই মাসে সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু করে ২০০৪ সালের জুনে শেষ করার কথা জানানো হয়। নির্মাণের জন্য প্রস্তাবিত টাকার ২৬৯৩.৫০ কোটি টাকা বিদেশী উৎস থেকে এবং ৭৫০ কোটি টাকা জাতীয় উৎস থেকে জোগান দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।পরে ১৯৯৯ সালের মে মাসে উক্ত সেতু প্রকল্পের জন্য প্রাক-সম্ভাব্যতা যাচাই পরীক্ষা শুরু হয়। ২০০১ সালের ৪ জুলাই মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ৮ম সাধারণ নির্বাচনের পর পরবর্তী সরকারের পরামর্শক কমিটি পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া পয়েন্ট, দোহার-চরভদ্রাসন পয়েন্ট, মাওয়া-জাজিরা পয়েন্ট এবং চাঁদপুর-ভেদরগঞ্জ পয়েন্টে প্রাক-বাস্তবায়নযোগ্যতার সমীক্ষা করায়। ২০০৪ সালে জাইকা (জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা) নিয়োজিত পরামর্শক নিপ্পন কোয়েই পদ্মা সেতু নির্মাণকল্পে বিস্তারিত সমীক্ষা পরিচালনার পর আগের নির্ধারিত মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টেই সেতু নির্মাণের পরামর্শ দেয়।
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্মা সেতু প্রকল্প পাস করলেও আওয়ামী লীগ সরকার এসে রেলপথ সংযুক্ত করে ও ২০১১ সালের ১১ জানুয়ারি প্রথম দফায় সেতুর ব্যয় সংশোধন করে। তখন এর ব্যয় ধরা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। পরে পদ্মা সেতুর ব্যয় আরও আট হাজার কোটি টাকা বাড়ানো হয়। ফলে তখন পদ্মা সেতুর ব্যয় দাঁড়ায় সসর্বমোট ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা।
২০১১ সালের এপ্রিল মাসে বিশ্বব্যাংকের সাথে বাংলাদেশের ১২০ কোটি মার্কিন ডলারের ঋণচুক্তি হয়। একই বছরের ১৮ মে জাইকার সঙ্গে সরকারের ৪১ কোটি ৫০ লাখ ডলার এবং ৬ জুন এডিবির সঙ্গে ৬১ কোটি ৫০ লাখ ডলারের ঋণচুক্তি হয়। ২০১১ সালের ১০ অক্টোবরে দুর্নীতির অভিযোগ এনে পদ্মা প্রকল্পে অর্থায়ন স্থগিত করে বিশ্বব্যাংক। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা মসিউর রহমানের নামও দুর্নীতির অভিযোগের সাথে যুক্ত হয়। ২০১১ সালের ১৪ নভেম্বর সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে বদলি করে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয় ও ৫ ডিসেম্বর তৎকালীন যোগাযোগ মন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়।
২০১৩ সালের ৩১ জানুয়ারি পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংকের অর্থ আর নেওয়া হবে না – সরকার এমন সিদ্ধান্তের কথা জানায়। ২০১৩ সালের ২৬ জুন আবার দরপত্র আহ্বান করা হয়।
ক্রমিক ব্যয়বৃদ্ধি
২০০৫ সালে পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য প্রাথমিক প্রাক্কলন ধরা হয়েছিল ১২,০০০ কোটি টাকা। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় পৃথিবীর অন্যান্য তুলনীয় সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের নিরিখে তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া সর্বমোট নির্মাণ ব্যয় ১০,০০০ কোটি টাকায় সীমিত রাখার পরামর্শ প্রদান করেন।
২০০৭ সালের আগস্ট মাসে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে একনেক-এর সভায় পদ্মা সেতুর চূড়ান্ত প্রাক্কলন ১০,১৬১ কোটি অনুমোদন করা হয়।
পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে প্রাক্কলন বৃদ্ধি করা হয়। সর্বশেষ অনুমোদিত প্রাক্কলনের পরিমাণ ৩০,১৯৩ কোটি টাকা, যা মূল প্রাক্কলনের চেয়ে ২০,০৩২ কোটি টাকা বেশি। বলা হয়েছে বাস্তবায়ন বিলম্বিত হওয়াই প্রকল্প ব্যয় এতো বৃদ্ধি পাওয়ার মূল কারণ।
মার্কিন ডলারের হিসাবে ৬.১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ পদ্মা সড়ক-রেল সেতুর নির্মাণ ব্যয় এগারো বছরে ১.৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩.৫৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। চীনের ৬.৪ কিলোমিটার দীর্ঘ উফেনসাং ইয়াংজি সড়ক-রেল সেতু ২০২০ সালের ডিসেম্বরে চালু করা হয়েছে। পদ্মা সেতুর সঙ্গে তুলনীয় এই সেতুর নির্মাণে ৪ বছর লেগেছে এবং ব্যয় হয়েছে ১.০৫ বিলিয়ন ডলার, যা পদ্মা সেতুর এক-তৃতীয়াংশের চেয়েও কম।
চুক্তি সংস্থা :
২০১৪ সালের ১৭ জুন পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ সরকার ও চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানির মধ্যে আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে চীনের কোম্পানিটি পদ্মাসেতু নির্মাণের দায়িত্ব পায়। পদ্মা সেতু নির্মাণে ২০১০ সালে প্রথম দরপত্র আহবান করা হলে সেখানে প্রাক-যোগ্যত অর্জনের জন্য ৪০টি কোম্পানি অংশ নেয়। বিশ্বব্যাংক, জাইকা ও এডিবির তত্বাবধানে এদের মধ্যে ৫টি কোম্পানিকে বাছাই করা হয়। পরে বিশ্বব্যাংকের আপত্তির কারণে একটি কোম্পানি বাদ পড়ে যায়। আর্থিক প্রস্তাব আহ্বান করলে শুধুমাত্র চীনের এই কোম্পানিটি আর্থিক প্রস্তাব জমা দেয়।কোম্পানিটি চায়না রেলওয়ে গ্রুপ লিমিটেডের অধীনস্থ।
২০২২ সালের এপ্রিলে সেতু বিভাগের অধীনে, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ কর্তৃক পদ্মা বহুমুখী সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায়ে কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে করপোরেশন ও চায়না মেজর ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং কম্পানি লিমিটেডকে নিয়োগ দেওয়া হয়।
পাইলিংয়ের সমস্যা
প্রথম দিকে সেতু নির্মাণকারী প্রকৌশলী ও বিশেষজ্ঞদের পদ্মা নদীর তলদেশের মাটি খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয়। তলদেশে স্বাভাবিক মাটি পাওয়া যায়নি। সেতুর পাইলিং কাজ শুরুর পরে সমস্যা দেখা যায়। প্রকৌশলীরা নদীর তলদেশে স্ক্রিন গ্রাউটিং পদ্ধতিতে কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় মাটির বদলে নতুন মাটি তৈরি করে পিলার গাঁথার চেষ্টা করে। এ প্রক্রিয়ায় উপর থেকে পাইপের ছিদ্র দিয়ে রাসায়নিক নদীর তলদেশে পাঠিয়ে মাটির শক্তিমত্তা বাড়ানো হয়। তারপর ওই মাটিতে পিলার গেঁথে দেওয়া হয়। এ পদ্ধতিতে পাইলের সঙ্গে স্টিলের ছোট ছোট পাইপ ওয়েল্ডিং করে দেওয়া হয়। পাইপের ভেতর দিয়ে এক ধরনের কেমিক্যাল পাঠিয়ে দেওয়া হয় নদীর তলদেশের মাটিতে। রাসায়নিকের প্রভাবে তখন তলদেশের সেই মাটি শক্ত রূপ ধারণ করে। এক পর্যায়ে সেই মাটি পাইলের লোড বহনে সক্ষম হয়ে উঠে, তখন আর পাইল বসাতে কোনো বাধা থাকে না।
নির্মাণব্যয়
পদ্মা সেতু নির্মাণে মোট খরচ করা হয় ৩০ হাজার ১৯৩ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। এসব খরচের মধ্যে রয়েছে সেতুর অবকাঠামো তৈরি, নদী শাসন, সংযোগ সড়ক, ভূমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসন ও পরিবেশ, বেতন-ভাতা ইত্যাদি। বাংলাদেশের অর্থ বিভাগের সঙ্গে সেতু বিভাগের চুক্তি অনুযায়ী, সেতু নির্মাণে ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দেয় সরকার। ১ শতাংশ সুদ হারে ৩৫ বছরের মধ্যে সেটি পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ।
উদ্বোদন :
২০২২ সালের ২৫ জুন সেতুটি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন ও পরের দিন থেকে এটি সাধারণ মানুষের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়।উদ্বোধন উপলক্ষে স্মারক ডাকটিকিট উন্মোচন করেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।[উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যুদ্ধবিমান ও জঙ্গী হেলিকপ্টার অ্যারোবেটিক ডিসপ্লে ও ফ্লাইপাস প্রদর্শন করে। সেতুটির উদ্বোধন উপলক্ষে পাকিস্তান, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান,চীন,রাশিয়া, ডেনমার্কসহ পৃথিবীর অনেক দেশের সরকার ও রাষ্ট্রদূত অভিনন্দন বার্তা পাঠায়। এছাড়াও উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধিও বাংলাদেশ সরকারকে অভিনন্দন জানান।
উদ্বোধনের পর জনসাধারণের জন্য সেতুটি উন্মুক্ত করে দেয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে কিছু বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।উন্মুক্ত করে দেওয়ার প্রথম দিনই গতিসীমা অমান্য করে মোটরবাইক চালাতে গিয়ে সড়ক দুর্ঘটনায় দুজন মৃত্যুবরণ করে।ফলশ্রুতিতে সেতুতে দায়িত্বপ্রাপ্ত সেনাসদস্যরা টহল কার্যক্রম জোরদার করেন এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত সেতুতে অভিযান পরিচালনায় নামে, পাশাপাশি সেতুতে যানবাহন থামানো, পার্কিং, পায়ে হেঁটে পার হওয়া ও মোটরসাইকেল চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়।
খবর সংগ্রহ : https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%AA%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%BE_%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%A4%E0%A7%81
ধন্যবাদ